সাপের খেলা

-কাজী মোঃ হাসান

এতোদিন রঞ্জুদের বাসাটা ছিলো থানার দক্ষিণ দিকে। পরের বৎসরই রঞ্জুর আব্বু থানার উত্তর দিকে বাড়ি কিনে চলে আসেন সেখানে। জায়গাটা থানার এক কিলোমিটারের মধ্যে।
জমিদারদের বিশাল জায়গা। বাড়ির আশে-পাশে প্রায় বিশ বিঘা জমি। সবটাই কেনেন তিনি। এর মধ্যে আছে দুটি পুকুর, একটি দিঘী। দিঘীটার পশ্চিম পাশে বিরাট ঘাটলা। তার চারপাশ ঘিরে বউইকাঁটা ভরা ছনক্ষেত। ছনগুলো বড় হয়ে উপচে পড়েছে দিঘীর পানিতে। এ ছাড়া এখানে সেখানে ইকরছোবার গোছা, ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু’একটা কড়ই ও তালগাছ।
আব্বু বাড়িটা কেনার পরপরই দাদা-দাদীকে নিয়ে আসেন আগের বাড়ি থেকে। তাঁদের পুনরায় কাছে পেয়ে রঞ্জুর মনটা খুশীতে চটাং চটাং।
এবার আব্বু ও দাদু মিলে বাড়িটা সাজাতে লাগলেন একদম মনের মতো। যেখানে যেটা খাটে, সেখানেই লাগিয়ে দিলেন বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ। সবুজ শ্যামলিমায় ভরে যায় পুরু চত্তর। তাকালেই চোখে পড়ে আম, জাম, কাঠাল, নারিকেল, বড়ই, পেয়ারা, লিচু, লটকর, কলা, সফেদা ও সুপারী গাছের সারি। রঞ্জু গুণে দেখেছে, তাদের বাড়িতে বিভিন্ন জাতের বড়ই গাছই আছে মোট তেরটা। এক একটার স্বাদ এক এক রকম। এ ছাড়া আছে লেবু, আমড়া, অরবড়ই, কামরাঙ্গা ও করমচার গাছ। এক কথায় কী নেই বাড়িতে?
বাড়ির নিরাপত্তার কথাও ভাবলেন আব্বু। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটো গেইট রেখে বাড়িটাকে ঘিরে বিশ হাতের মতো চওড়া করে ছোটখাট পুকুর কেটে ফেললেন। বাড়িটা যেন এক দুর্গ।
জমিজমা রাখলেই তো হয় না, এগুলো দেখাশুনা করার জন্য উপযুক্ত লোক চাই। রাখা হয় জিন্নত আলীকে। এখানেই বাড়ি। পাশের গায়ে। ভীষণ সৎ এবং পরিশ্রমী। তিনি পরের কাজকে নিজের মতো করেই দেখেন। সব কাজেই আন্তুরিকতার ছোঁয়া। বিষয়টায় মন ছুঁয়ে যায় সবার। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িসুদ্ধো লোক তার ভক্ত হয়ে যায়। তিনিও ভালবাসা দিয়ে আপন করে নেন সবাইকে। বেশি দিন যেতে না যেতেই চালচলন, সততা ও নিষ্ঠার কারণে বাড়ির একজন অপরিহার্য মানুষ হয়ে উঠেন তিনি।

কিছুদিন পর। আব্বু আরো জমি কেনেন। এতো জমি-জমা, গরু-বাছুরের যতœ নেয়া জিন্নত আলীর একার পক্ষে অসম্ভব। রাখা হয় আরো দু’জন কাজের লোক। একজন চরের। বয়স বড়জোড় সতেরো কী আঠারো। নাম মিছির আলী। অন্যজন কুমিল্ল¬¬ার- মজনু মিয়া। তিনি মিছির আলীর চাইতে একটু বয়ষ্ক। সরল সোজা গো বেচারা ধরণের।
এই মিছির আলী কিন্তু অদ্ভত চরিত্রের। কিছুটা বোকাও। তার সামনে যে যাই বলুক, সেটার সমালোচনা করতে না পারলে তার পেটের ভাত হজম হতো না। সমালোচনার শুরুটা হতো এভাবেÑ
: ভাই, আপনের কতাডা ঠিকই অইছে, তবে কতার অর্ত অয় নাই।
যার কথা নিয়ে সমালোচনা সে জবাব না দিয়ে ছাড়বে কেন? তিনি উল্টো প্রশ্ন রাখতেন-
: আরে বোকা, যদি কথাই ঠিক হয়, তাহলে কথার অর্থ হবে না কেন?
মিছির আলীর অভিমতের বিপক্ষে যত যুক্তি, যত প্রমাণই থাকুক না কেন- মিছির আলীর এক কথা-
: না, আপনের কতার কোন অর্ত অয় নাই।
আপনি যতই বুঝান, মিছিল আলী বুঝতে নারাজ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার সেই এক কথা-
: আমি নিশ্চিত কইরা কইতে পারি, আপনার কতার অর্থ অয় নাই।
: তবে কি ভাবে হবে?
এবার মিছির আলী যা বলতেন তা আরো হাস্যকর। তার এই আচরণ নিয়ে ভীষণ মজা করতো সবাই। কিন্তু মিছির আলীর তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। সে তার মন্তব্যে অটল।
দীর্ঘ সাত বৎসর রঞ্জুদের বাড়িতে কাটিয়েছিলেন মিছির আলী। আর জিন্নত আলী কাকা এরচেয়েও বেশী।
পরবর্তী কালে এই জিন্নত আলী কাকা তার সততার জন্য সামাজিক জীবনে অনেক সম্মানীত ব্যক্তি হিসাবে মর্যাদা পান। চৌকাঠ করা ঘর করেন বাড়িতে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করান। শেষ দিকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যন্ত হয়ে যান জনগণের ভোটে। জিন্নত আলীর পূঁজি কিন্তু একটাই- সততা।
কাজের লোকেরা যতই বোকা হোক বা মুর্খ হোক, রঞ্জুরা তাদের কোন মতেই অসম্মান করে কথা বলার সাহস পেতো না। আব্বুর কড়া হুকুম- পুরুষ কাজের লোকদের ‘কাকা’ এবং ঘরের ভেতরে কাজের মেয়েদের বুয়া না ডেকে ‘খালা’ ডাকতে হবে। শুধু তাই নয়, খাওয়া-দাওয়াও হতো এক সাথে, এক বিছানায় বসে। চাকর বলে চেয়ারে বসতে না দেয়া অথবা আলাদা ভাবে বসানো হতো না। তাদের বাড়িতে এই রেওয়াজটা আজো চালু আছে।
একদিন সকালের নাস্তা খেয়ে যার যার কাজে বের হচ্ছিলেন সবাই। এমন সময় হন্তদস্ত হয়ে মিছির আলী কাকা এসে হাজির। এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে যা বললেন তার মাথা-মু-ু বুঝার সাধ্য কারো নেই। আসলে, তার মুখ দিয়ে স্পষ্ট ভাবে কোন কথাই বের হচ্ছিলো না। মনে হয়, ভীষণ ভয় পেয়েছেন। তবু তোতলাতে তোতলাতে যা বললেন তা এ রকম-
: সাপ, বড় বড় সাপ।
: কোথায় সাপ? জানতে চাইলেন দাদু।
: ঐ ছন ভিটায়। ঘুরতে ঘুরতে এইদিকেই আইতাছে। যদি হাছা হাছাই আইয়া পড়ে তয় আমাদের কি অইব?
তার কথা শুনে ঘর থেকে বের হয়ে কথাটা সত্য না মিথ্যা দেখতে গেলেন দাদু। রঞ্জুরাও দাদুর পিছু নেয় লাঠিসোটা নিয়ে। গিয়ে দেখে- ঠিকই, চারটা জাতি সাপ মারামারি করছে। আর ঘুরে বেড়াচ্ছে চরকির মতো। ফাঁকে ফাঁকে ফনা তুলে ছোবল দিচ্ছে, পেঁচিয়ে ধরছে একে অপরকে। অবস্থা দেখে মুরুব্বিরা চিৎকার করে সাবধান করে দিলেন বাচ্চাদের-
: এই পোলাপাইন! সর সর, সামনে যাবি না। সাপেরা সং লাগছে। এহন কোন মতে ব্যথা পাইলে আর রক্ষা নাই। যেয় ব্যাথা দিব হেরে কামড়াইয়া মাইরা ফেলাইব। এহন না পারলেও রাইতে চুপেচুপে বাড়ি গিয়া ছোবল দিব।
কথাটা সত্যি কি-না জানা নেই কারোর? সত্য হলে তো খুব ভয়ের কথা! তাই দূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাপের খেলা দেখতে থাকে রঞ্জুরা।
দেখতে দেখতে মাটি ফুঁড়ে আরও দু’টি সাপ বেরিয়ে আসে। যোগ দেয় আগেরগুলো সাথে। এখন মোট ছয়টা। এসেই ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে পূর্বের সাপগুলোর সাথে। বাপরে বাপ! এক সঙ্গে এতো সাপ আগে কখনো দেখেনি কেউ! এদিকে সং দেখার জন্য লোকের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কয়েকশ’।
চোখের পলকে রঞ্জুদের পুরু এলাকাটাই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। তাদের মধ্যে পুলিশও ছিলেন কয়েকজন। সাপ মারার জন্য বন্ধুক নিয়ে এসেছিলেন। সাথে ছড়্ড়া গুলি। কিন্তু এতোগুলো সাপ দেখে তারাও বন্দুক ছুড়তে সাহস করেননি। কোন ভাবে যদি একটাও বেঁচে যায়, তা হলে- কি হবে, কে জানে!
সং চলে দুপুর পর্যন্ত। সূর্য একটু পশ্চিম দিকে হেলে পড়তেই ওগুলো রঞ্জুদের কড়ই গাছের কাছে এসে সং থামিয়ে জটলা বাঁধে। ফোঁস ফোঁস শব্দে মাথা দোলাতে শুরু করে। পাঁচ-সাত মিনিটের পর সেটাও বন্ধ। হঠাৎ মাথা নামিয়ে ছুটে যায় পুকুরের শান্ত জলে।

(চলবে…………)
(“রঞ্জুর ছেলেবেলা” থেকে)

Related posts

Leave a Comment